জরায়ু মুখে ক্যান্সার নারীর অন্যতম রোগ ও তার প্রতিকার
নারীর জরায়ু -মুখে একটি মারাত্বক ক্ষতিকর টিউমার হলো জরায়ু -মুখ ক্যান্সার। হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) নামক একটি ঘাতক ভাইরাস দ্বারা দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ হলে এই রোগ হতে পারে। একজন নারী সহজাত শারীরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বা কনডোমের ব্যবহার কখনও এই ইনফেকশনের বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিরোধকারী হিসেবে কাজ করতে পারে না। যৌন সক্রিয় প্রতিটি নারীরই তার এই ঝুঁকি রয়েছে। সংক্রমণ হবার পর জরায়ুমুখ ক্যান্সার হতে প্রায় ১০-১২ বছর সময় লাগে।
জরায়ু মুখে ক্যান্সার কী?
জরায়ু মুখের আবরণ কোষগুলো যখন অস্বাভাবিক ও অনিয়ন্ত্রিত ভাবে বাড়তে থাকে তখনই জরায়ুর মুখের ক্যান্সার হয়।
রোগের প্রকোপ: জরায়ুমুখ ক্যান্সার বাংলাদেশের ১৫-৪৫ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান ক্যান্সার। বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১২ হাজার জন নারী জরায়ু মুখ- ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়।
সংক্রমণ: যৌন সংস্পর্শ এই রোগ ছড়ানোর প্রধান মাধ্যম। শতকরা ৮০ ভাগ নারী তাদের জীবনে এইচ.পি.ভি ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়।
কাদের জরায়ু ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা?
-
অপরিণত বয়সে যৌনসংগম;
-
খুব কম বয়সে বিয়ে ও সন্তান প্রসব;
-
যে নারীর একাধিক যৌনসঙ্গী আছে;
-
যে নারীর স্বামীর অন্য একাধিক যৌনসঙ্গী আছে;
-
যৌনাঙ্গে সংক্রমণ রোগ হওয়া;
-
ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়া;
-
অতিরিক্ত ধূমপান করা;
জরায়ুর মুখে ক্যান্সারের উপসর্গ বা লক্ষণ কী কী?
-
অনিয়মিতভাবে মাসিকের রাস্তা দিয়ে রক্তস্রাব;
-
স্বামী সহবাসে রক্তক্ষরণ;
-
মাসিকের রাস্তা দিয়ে দুর্গন্ধজনিত স্রাব যাওয়া;
-
মাসিক বন্ধের পর রক্তপাত;
রোগ নির্ণয়
জরায়ুর মুখে ক্যান্সার সূচনায় কিছু পরীক্ষার (Screening) মাধ্যমে সনাক্ত করা যায়।
-
ভায়া টেস্ট;
-
পেপস টেস্ট;
-
কলপোস্কস্পি;
-
এইচ.পি.ভি –ডিএনএ টেস্ট
কখন থেকে সূচনার সনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু করবো?
-
৩০ বছরের বেশী বয়স হলেই বিবাহিত মহিলাদের জরায়ুর মুখ অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে।
-
তবে ১৮ বছরের পূর্বে বিবাহিত মহিলাদের ক্ষেত্রে বিবাহের ৩ বছর পর থেকেই জরায়ুর মুখ পরীক্ষা করা উচিত।
-
প্রতি ৩ (তিন) বছর পর পর স্বাস্থ্য কর্মীকে দিয়ে জরায়ুর মুখ পরীক্ষা করাতে হবে।
-
কোন উপসর্গ দেখা যাওয়া মাত্র ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
জরায়ুর মুখে ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়
-
ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ পরিহার করা। ধূমপান পরিহার করা।
-
বাল্য বিবাহ থেকে বিরত থাকা।
-
নিয়মিত জরায়ুর মুখের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে রোগ সনাক্ত করাা ও ব্যবস্থা নেওয়া।
-
প্রতিরোধের টিকা গ্রহণ করা ( এইচ.পি.ভি ভ্যাকসিন)
চিকিৎসা: কলপোস্কপি, বায়োপসি ও কোন বায়োপসি পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুমুখ ক্যান্সার সনাক্ত করা হয়। আমাদের দেশের অনেক নারীর জরায়ুর মুখের ক্যান্সার একেবারেই শেষ পর্যায়ে ধরা পড়ে, তখন পর্যাপ্ত চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। জরায়ুর মুখ ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের বিস্তারের উপর। চিকিৎসা পদ্ধতি মূলত তিন ধরনের।
-
অপারেশন
-
রেডিও থেরাপি
-
কেমো থেরাপি
সাধারণত জরায়ুমুখ ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ু মুখ অপারেশন করে কেটে ফেলা হয়, ফলে একজন নারী মা হবার ক্ষমতা হারাতে পারেন। যদি রোগ বেশী ছড়িয়ে পড়ে তবে কেমো থেরাপি বা রেডিও থেরাপি দেওয়া হয়। কেমো থেরাপি বা রেডিও থেরাপি ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসা। জরায়ুমুখ ক্যান্সার রোগীকে শুধু শারীরিক ভাবে নয় মানসিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্থ করে।
উপসংহার: জরায়ু মুখ ক্যান্সার একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। শুধুমাত্র এর মাধ্যমে ঝপৎববহরহম ৭০% ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। এটি বিশ^ব্যাপী নারী মৃত্যুর প্রধান কারণ। বর্তমান বিশে^র প্রতি দুই মিনিটে একজন নারী জরায়ু –- মুখে ক্যান্সারে মৃত্যু বরণ করেন এবং প্রতি বছর অর্ধকোটি নারী নতুন করে আক্রান্ত হয়। আর বাংলাদেশে প্রতি দিন সারা দেশে গড়ে ১৮ জন এবং বছর প্রায় ৬৮৫২ জন নারী মারা যাচ্ছে। আসুন আমরা সব নারী এই ক্যান্সার সম্পর্কে জানি, সচেতন হই এবং প্রতিরোধ গড়ি।
ডা:
শিউলি বেগম
এমবিবিএস, এফসিপিএস, এমএস (গাইনী এন্ড অবস)
বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসক
স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন
সহযোগী অধ্যাপক
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা।