হাঁটুর স্পোর্টস ইনজুরি ও করণীয়
বাস্তব সত্য যে, জীবনের কোন না কোন সময় সৌখিন বা পেশাগত খেলোয়ার হাঁটু ইনজুরিতে আক্রান্ত হয় । অনেক খেলোয়ার স্পোর্টস ইনজুরি ভোগান্তির পর খেলায় ফুরো দমে ফিরে আসতে পারে । অনেকে খেলায় ফিরলেও পূর্বের খেলা প্রর্দশন করতে পারে না । আবার অনেক খেলোয়ারকে যথোপযুক্ত চিকিৎসা এবং পরিমিত পরিচর্যার অভাবে খেলোয়ারী জীবনের পরিসমাপ্তি টানতে হয় । শরীরের বড় ও ওজন বহনকারী জোড়াগুলির মধ্যে অন্যতম বিধায় হাঁটু স্পোর্টস ইনজুরিতে আক্রা›ত হয় বেশী । হাঁটু জোড়া তিন হাড়ের সমন্বয়ে গঠিত । হাঁটুতে চারটি প্রধান লিগামেন্ট ও দুইটি মেনিসকাস (তরুনাস্থি) থাকে । লিগামেন্ট হলো ইলাসটিক টিসু যা এক হাড়কে অন্য হাড়ের সাথে যুক্ত করে, জোড়ায় শক্তি প্রদান করে, হাড়ের নড়াচড়ায় অংশ গ্রহন করে এবং জোড়ার স্থিতিশীলতা বজায় রাখে। মেনিসকাস (তরুনাস্থি) শরীরের ওজন সমভাবে উরুর হাড় থেকে পায়ের হাড়ে সরবরাহ করে, হাড়ের প্রয়োজনীয় নড়াচড়ায় সহায়তা করে এবং জোড়ার দূঢ় অব¯হা বজায় রাখে । ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাস্কেটবল, ভলিবল, হ্যান্ডবল, কাবাডি ও হাডুডু খেলোয়ারদের হাঁটুতে স্পোর্টস ইনজুরি হয় । এ ধরনের অধিকাংশ স্পোর্টস ইনজুরি মচকানো (টুইসটিং) প্রকৃতির । এক খেলোয়ারের সাথে অন্য খেলোয়ারের সংঘর্ষের ফলে হাঁটতেু স্পোর্টস ইনজুরি হয় । অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংঘর্ষ ছাড়াই (নন - কনট্র্যাক্ট) বিভিন্ন পরিস্থিতে হাঁটু ও পায়ের বিভিন্ন অবস্থানের জন্য লেগের হাড়ের (টিবিয়া) বাহির বা ভিতর ঘূর্ণন হয় অথবা সামনে বা পিছনে সরে যায় । এ ধরনের আঘাতে হাঁটুর লিগামেন্ট ও মেনিসকাস ইনজুরি হয়ে থাকে । স্পোর্টস ইনজুরিতে লিগামেন্ট বিস্তৃত হতে পারে এবং আংশিক বা সম্পূর্ন ছিড়ে যেতে পারে । হাঁটুর মচকানোর জন্য মেনিসকাসের বিভিন্ন ধরনের ইনজুরি ছাড়াও মেনিসকাস আংশিক বা সম্পূর্ন টিয়ার হতে পারে । ফুটবল, ক্রিকেট,ভলিবল, বাস্কেটবল, হাডুডু ও হকি খেলোয়ারদের মাঝে এনটেরিওর ক্রুসিয়েট ও মিডিয়াল কোল্যাটারাল লিগামেন্ট ইনজুরি বেশী হয় । ৭০% ব্যক্তির এনটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট ইনজুরির সাথে মেনিসকাস ইনজুরি থাকে । এ ছাড়াও জোড়ার হাড় (টিবিয়াল স্পাইন) ফ্র্যাকচার হতে পারে ।
স্পোর্টস ইনজুরির লক্ষণসমূহ:
-
আক্রান্ত ব্যক্তি আঘাতের সাথে সাথে ”পপ” বা ”ক্র্যাক” শব্দ শুনতে বা বুঝতে পারবে ।
-
প্রথমে তীব্র ব্যথা পরে আস্তে আস্তে ব্যথা কমে আসে। এ ব্যথা হাঁটুর বাহির পার্শ্বে এবং পিছনে অনুভূত হবে । হাঁটু ভাঁজ বা সোজা করতে গেলে ব্যথা বেড়ে যায় ।
-
আঘাতের প্রথম দশ মিনিটের মধ্যে হাঁটু ফুলে যায় । ú্রথম না ফুললে বার থেকে চব্বিশ ঘন্টা পরও হাঁটু ফুলতে পারে ।
-
পড়ে গেলে, দাঁড়াতে বা হাটতে চেষ্টা করলে মনে হবে হাঁটু ছুটে যাচ্ছে বা বেঁকে যাচ্ছে ।
-
ফুলা ও ব্যথার জন্য হাঁটু নড়াচড়া করা যায় না ।
-
হাঁটু সোজা করতে কষ্ট হয় ।
-
অনেক সময় হাঁটু আটকিয়ে যায়, বেশীক্ষন বসলে রোগী হাঁটুকে নড়াচড়া করিয়ে সোজা করে ।
-
উঁচু নিচু জায়গায় হাঁটা যায় না , সিড়ি দিয়ে উঠা নামা করতে এবং বসলে উঠতে কষ্ট হয় ।
-
হাঁটু অ¯িহতিশীল বা ছুটে বা ঘুরে যাচ্ছে, এরকম মনে হবে ।
-
দীর্ঘদিন যাবৎ লিগামেন্ট ইনজুরি থাকলে হাঁটুর পেশী শুকিয়ে যায় এবং হাঁটুতে শক্তি কমে যায় ।
-
সঠিক সময়ে চিকিৎসা না পেলে মাঝে মাঝে হাঁটু ফুলে, হাড় ও তরুনাস্থি ক্ষয় হয় এবং অল্প বয়সে ওসটিওআর্থ্রাইটিস হয় ।
প্রাথমিক করণীয়:
১. হাঁটুকে পূর্ন বিশ্রামে রাখতে হবে ।
২. বরফের টুকরা টাওয়ালে বা ফ্রিজের ঠান্ডা পানি প্লাস্টিকের বেগে নিয়ে লাগালে ব্যথা ও ফুলা কমে আসবে । প্রতি ঘন্টায় ১০ মিনিট বা দুই ঘন্টা পর পর ২০ মিনিট অনবরত লাগাতে হবে । তবে ইহা সহ্যের মধ্যে রাখতে হবে । এই পদ্বতি আঘাতের ৪৮ - ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত চলবে ।
৩. হাঁটুতে ইলাসটো কমপ্রেসন বা স্পিøন্ট ব্যবহারে ফুলা ও ব্যথা কমে আসে ।
৪. হাঁটুর নিচে বালিশ দিয়ে হাঁটুকে হার্টের লেবেল থেকে উঁচুতে রাখলে ফুলা কম হবে।
৫. এনালজেসিক বা ব্যথানাশক ওষুধ সেবন ।
৬. হাঁটুর লিগামেন্ট ইনজুরির চিকিৎসা প্রদান করতে সক্ষম এমন চিকিৎসকের কাছে বা সেন্টারে রোগীকে পাঠাতে হবে ।
প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বা করণীয়:
প্রাথমিক চিকিৎসায় রোগীর ব্যথা ও ফুলা সেরে উঠার পর, হাঁটুর বিভিন্ন শারিরীক পরীক্ষার মাধ্যমে কি কি লিগামেন্ট ইনজুরি হয়েছে এবং এর তীব্রতা নির্ণয় করা যায় । কখনও কখনও এক্স-রে ও এম. আর. আই. এর সাহায্য নিতে হয় । হাঁটুর লিগামেন্ট বি¯তৃত (স্ট্রেস) ইনজুরি ও মেনিসকাসের ক্ষুদ্র ইনজুরি হলে প্রাথমিক চিকিৎসায় ভালো হয় এবং খেলোয়ার খেলায় ফিরে যেতে পারে। তবে কিছু কিছু আংশিক টিয়ারের ক্ষেত্রে হাঁটুর পেশীর ব্যায়াম ও দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিবর্তনের মাধ্যমে সু¯হ থাকা যায় এবং নিয়ন্ত্রিত খেলা খেলতে পারবে। ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট ইনজুরি হলে নতুন করে লিগামেন্ট তৈরী করতে হয় । এর মধ্যে এনটেরিওর ক্রুসিয়েট লিগামেন্ট তৈরী করা জরুরী কারণ ইহা না করলে হাঁটু অভিহিতশীল হবে এবং হাঁটুতে তাড়াতাড়ি ওসটিওআর্থ্রাইটিস হয়ে জোড়া নষ্ট হবে । বর্তমানে হাঁটুর বাহির থেকে টেনডন নিয়ে ছোট দুইটি ছিদ্র দিয়ে আর্থ্রােস্কোপ যন্ত্র হাঁটুতে প্রবেশ করিয়ে নতুন লিগামেন্ট তৈরী করা হয় । বড় ধরনের মেনিসকাস ইনজুরির হলে রিপেয়ার বা রিমোভ করা হয় । আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারীর পর নিয়মিত ও পরিমিত পরিচর্যার (রিহেবিলিটেশন) মাধ্যমে রোগী দ্রত সুস্থ হয়ে উঠবে এবং খেলায় ফিরে যেতে পারবে। তবে স্পোর্টস ইনজুরি চিকিৎসার চেয়ে বিভিন্ন কলা কৌশল ও উপযুক্ত প্রশিক্ষন লদ্ধ করে একে প্রতিরোধ করাই শ্রেয় ।
ডাঃ জি, এম, জাহাঙ্গীর হোসেন
কনসালটেন্ট - হাড়, জোড়া, ট্রমা ও আর্থ্রোস্কোপিক সার্জারী
আর্থ্রোস্কোপিক সেন্টার : সিটি হাসপাতাল, সাতমসজিদ রোড, লালমাটিয়া, ঢাকা ।
চেম্বার : ডিজিল্যাব মেডিকেল সার্ভিসেস, মিরপুর -১০, ঢাকা ।