আপনি যখন সুস্থ থাকেন এবং সবকিছু ঠিকমতো চলে, তখন ধরেই নেয়া যায় আপনার স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে। বেশির ভাগ মানুষই জানেন ধূমপান, অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ অথবা অপর্যাপ্ত ব্যায়াম কখনোই স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। যতক্ষণ তারা সুস্থ থাকেন, ততক্ষণ তারা এ ব্যাপারটিকে ততটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেন না। ঠিক সে রকমই, হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগ ধরার আগ পর্যন্ত মানুষ জানতে পারেন না তার জীবনে কি ধরনের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
পোস্ট হৃৎপিণ্ড রক্তনালির পুনর্বাসন
এটি করোনারি ইন্টারভেনশন রোগীদের জন্য একটি বিশেষ কার্যক্রম। এটা তাদের করোনারি আর্টারি (হৃৎপিণ্ড রক্তনালি) রোগ সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করবে এবং ভবিষ্যতে হৃৎপিণ্ডকে রক্ষা করার জন্য কি করা উচিত এবং কি করা উচিত নয় সে সম্পর্কে ধারণা দেবে। আধুনিক বিজ্ঞান হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। চিকিৎসার সার্থকতা নির্ভর করে রোগীর ওপরও। নিয়মিত ডাক্তার দেখানো, ডাক্তারের উপদেশ মতো ওষুধ সেবন এবং জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো মেনে চলার মাধ্যমে একজন রোগী তার হৃৎপিণ্ডকে নিরোগ এবং স্বাস্থ্য সম্মতভাবে ফিরে পেতে পারেন।
রোগীদের উচিত করোনারি ইন্টারভেনশন পদ্ধতিটিকে একটি সুযোগ হিসেবে বিবেচনা করা। এটি এমন একটি সুযোগ যা তার হৃৎপিণ্ডকে ভবিষ্যতে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে, এমন কিছু করা থেকে বিরত রাখবে যা তার হৃৎপিণ্ডের জন্য ক্ষতিকর এবং যা তার হৃৎপিণ্ডের জন্য ভালো তা করতে সাহায্য করবে। জীবনযাত্রার পরিবর্তনের এ বিষয়টি নিয়ে আপনারা আপনাদের বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলাপ করবেন, যাতে তারাও বুঝতে পারে রোগীর জন্য কোন নিয়মটি মেনে চলা উচিত। এজন্য রোগীদের উচিত ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা, তার পরামর্শমতো চলা এবং যে কোনো সমস্যায় ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া। সুস্থ জীবনের জন্য অনেক কিছুই করার রয়েছে এবং নিজের জন্য কিছু শুরু করার সময় কিন্তু কখনোই দেরি হয়ে যায় না।
করোনারি ইন্টারভেনশনের পর নতুন জীবন শুরু
করোনারি ইন্টারভেনশনের মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালিতে রক্ত সরবরাহ আবার আগের মতো হয়ে যায়। হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির অন্য অংশে যে প্লাক জমা হচ্ছিল সেগুলো থেকেই যায় এবং রোগী যদি ইন্টারভেনশনের পর আবার আগের জীবনে ফিরে যান তাহলে পরে আবার অপারেশন লাগার আশংকা অনেক বেশি।
এটা কখনোই হওয়া উচিত নয়। সামান্য কিছু নিয়ম মেনে চললে ভবিষ্যতে এ ধরনের একটি ইন্টারভেনশন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। রক্তনালিতে যেন পরবর্তীতে নতুন করে প্লাক জমা না হয়, তা থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব এবং এটা তখনই সম্ভব যখন রোগী তার জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করবেন।
রোগীর যা করা প্রয়োজন
* নিয়মিত ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা
* নিয়মিত ওষুধ সেবন করা
* খাদ্যাভাস পরিবর্তন করা
* হালকা ব্যায়ামের অভ্যাস করা
* মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা
* অতিরিক্ত ওজন কমানো
* ধূমপান বর্জন করা
* মদ্যপান থেকে বিরত থাকা
মেডিকেল চিকিৎসা
ইন্টারভেনশনের পরবর্তী সময়ে একজন রোগীকে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যেতে হয়। যদি কোনো রোগের লক্ষণ নাও থাকে, তাহলেও এ স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে হবে। যদি বুকের ব্যথা নতুন করে দেখা দেয় বা আগের চেয়ে বেড়ে যায়, তাহলে অতি শিগগির ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হবে। বছরে অন্তত একবার একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা উচিত।
স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সাধারণত নিুলিখিত পরীক্ষাগুলো করা হয়ে থাকে
রক্ত পরীক্ষা : রক্তের কলস্টেরলের পরিমাণ, রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ, রক্তে রক্ত জমাট বাঁধার উপাদানের পরিমাণ এবং কিছু এনজাইম যা করোনারি রক্তনালি রোগের রোগীদের রক্তে থাকে।
ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম (ইসিজি) : এটি এমন একটি পরীক্ষা যার মাধ্যমে হৃৎপিণ্ডের সংকোচন প্রসারণ পরিমাপ করা যায় এবং হৃৎপিণ্ডের অনিয়মিত স্পন্দন মাপা হয়।
ইটিটি বা চাপ ইসিজি : এ পরীক্ষায় একজন মানুষের বিশ্রামরত অবস্থায় এবং ব্যায়ামরত অবস্থায় ইসিজি করে হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতার পার্থক্য পরীক্ষা করে দেখা হয়।
ইকোকার্ডিওগ্রাম
এ পরীক্ষার মাধ্যমে উচ্চ মাত্রার শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে হৃৎপিণ্ডের বিভিন্ন অংশের পরীক্ষা করা হয়।
রোগীর তথ্য সংরক্ষণ
হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগের রোগীর জন্য তথ্য সংরক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সঠিকভাবে তথ্য সংরক্ষণ করা থাকলে অর্থাৎ রক্তের কলস্টেরল, রক্তের গ্লুকোজ এবং রক্তচাপ ইত্যাদি নিয়মিত ব্যবধানে পরীক্ষা করা থাকলে রোগী সহজেই বুঝতে পারবেন তার জীবনযাত্রার মানে আর কি কি পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
ব্যায়াম এবং মানসিক চাপ কমানো
হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগের রোগীদের জীবনে ব্যায়াম একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মনে রাখতে হবে ব্যায়ামটি হতে হবে সঠিক এবং উপযুক্ত মাত্রায়। এজন্য রোগীকে সব সময় ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে। বিশেষ কিছু হৃৎপিণ্ডের রোগীদের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যসব রোগী সাধারণ কিছু ব্যায়ামের সাহায্যে নিজেদের জীবনকে সচল রাখতে পারেন।
ভালো খাদ্যাভাস গড়ে তুলুন
রক্তের কলস্টেরল কমানোর জন্য অথবা ওজন কমানোর জন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন গুরুত্বপূর্ণ, রক্তনালির ভেতর চর্বি জমে প্লাক তৈরির পেছনে কলস্টেরল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পশু এবং পাখি থেকে পাওয়া আমিষে উচ্চমাত্রায় কলস্টেরল থাকে। তাই এগুলো সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত। এসব খাদ্যের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পৃক্ত চর্বি থাকে। এসব খাদ্য পরিহার করা উচিত।
যে খাবার পরিহার করুন
* ভাজা খাবার, আলু ভাজি, আলুর চিপস
* মাখনে ভেজানো শাকসবজি
* চর্বিযুক্ত দুধ
* গরু, খাসির মাংস
* ডিমের কুসুম
* পনির, পেস্ট্রি, আইসক্রিম
* মাখন, মার্জারিন
বেশি করে খান
* রুটি, লাল আটার তৈরি খাবার
* ফলমূল, শাকসবজি
* সেদ্ধ করা অথবা তাজা খাবার
* ননিবিহীন দুধ
* মাছ, চামড়া ছাড়া মুরগি
* ডিমের সাদা অংশ
* দধি
* অলিভ ওয়েল ইত্যাদি
ওষুধ সেবন
যদিও ইন্টারভেনশন করা অধিকাংশ রোগীই আগে থেকে অনেক ওষুধ সেবন করছেন, এছাড়াও ইন্টারভেনশন করার পর তাদের আরও কিছু ওষুধ সেবনের প্রয়োজন হতে পারে। এ ওষুধগুলো কিছু ব্যথা কমাতে সাহায্য করবে আর কিছু ওষুধ হৃৎপিণ্ডের রক্তনালির সমস্যা থেকে নিরাপদে রাখবে।
চিকিৎসক এটাও লক্ষ্য রাখেন, করোনারি ইন্টারভেনশনের পর একজন রোগী অনেক ওষুধ সেবন করে থাকেন। তিনি সব সময়ই চেষ্টা করেন তার রোগীর জন্য সর্বোত্তম ওষুধের পরামর্শ দেয়ার জন্য এবং এ ক্ষেত্রে রোগীর দায়িত্ব থাকে, চিকিৎসককে সঠিক সময়ে তার অসুস্থতা সম্পর্কে সঠিক তথ্য দিয়ে সাহায্য করা। এ কাজটি তখনই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব যখন রোগীর সব তথ্য সংগঠিতভাবে একটি জায়গায় সংরক্ষণ করা থাকে।
ডা. মোহাম্মদ সাইফউল্লাহ
Ref:Dju
©2014 Copyright by Micron Techno. All rights reserved.