রেটিনা হচ্ছে চোখের ভিতরের একটি সংবেদনশীল পর্দা যেখানে আমরা যা দেখি সেই ছবিটি ধারণকৃত হয়। আমরা যখন চোখে কম দেখি তখন স্বাভাবিকভাবে মনে হয় চোখের চশমাজনিত অথবা ছানিজনিত সমস্যা হয়েছে।
উপরোক্ত সমস্যা ছাড়া চোখের একবারে ভিতরের অংশ রেটিনায় অনেক অসুবিধার জন্য চোখে কম দেখার বিষয়টি অনেক সময় আমাদের বিবেচনায় থাকে না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রেটিনার রোগজনিত কারণে কম দেখার বিষয়টি আমরা কিভাবে বুঝতে পারব।
প্রথমত : রেটিনাজনিত কারণে চোখে কম দেখার বিষয়টি রোগীদের বুঝতে পারা কঠিন কাজ। সাধারণত চোখে কম দেখলে রোগীরা চোখের ডাক্তারের কাছে যান এবং চোখের দৃষ্টিশক্তির সমস্যাটি রেটিনার কারণে হয়েছে কি না তা নিরূপণ করে রেটিনা বিশেষজ্ঞের নিকট পাঠিয়ে থাকেন। এ ধরনের যোগাযোগ বিলম্বিত হওয়ার কারণে রোগীর দৃষ্টি শক্তির মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে- রেটিনাজনিত কারণে দৃষ্টিশক্তির সমস্যার বিশেষ কোনো লক্ষণ আছে কি না? বলতে গেলে চোখের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস চশমা দ্বারা উন্নতি না হলে, আঘাতজনিত কারণে চোখে কম দেখলে, চোখের সামনে কালো কিছু ভাসতে থাকলে, চোখের সামনে আলোর ঝলকানো দেখা দিলে, চোখে কালো পর্দার মতো কিছু পড়তে দেখলে এবং কোনো ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি হঠাৎ করে কমে গেলে রেটিনাজনিত কারণে চোখের সমস্যা হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে রেটিনার জন্য দৃষ্টিশক্তি কমলে চোখে কোনো ব্যথা অনুভূত হয় না।
দ্বিতীয়ত : রেটিনার রোগ বয়স ও কারণভেদে বিভিন্ন রকমের হতে পারে। কোনো কোনো রোগ জন্মের কিছু দিনের মধ্যে চিকিৎসা না করালে সারা জীবন অন্ধত্ব বরণ করতে হয়। যেসব শিশু মায়ের গর্ভে আট মাস অথবা তার আগেই ভূমিষ্ট হয় অথবা জন্মের সময় ওজন দেড় কেজি বা তার কম হয় সেসব শিশুর জন্মের ত্রিশ দিনের মধ্যে অবশ্যই রেটিনা পরীক্ষা করা জরুরি।
শিশুদের আরেকটি রোগ হল রেটিনার টিউমার। সাধারণত তিন বছর অথবা তার নিচে শিশুরা চোখে কম দেখলে অথবা শিশুদের চোখের মণি সাদা দেখা গেলে তা জন্মগত ছানি বলে আমরা ধারণা করে থাকি। একই রকম উপসর্গ শিশুদের রেটিনা টিউমার হলেও হতে পারে। সঠিক সময়ে রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসা না করলে সারা জীবনের জন্য রোগী অন্ধ হতে পারে এমনকি শিশুর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আশার কথা হল, সঠিক সময়ে উপরোক্ত দুইটি রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করালে দৃষ্টিশক্তি সংরক্ষণ করা সম্ভব। এ ধরনের চিকিৎসা স্বল্প মূল্যে বাংলাদেশেই সম্ভব।
তৃতীয়ত : আমাদের শারীরিক অনেক রোগ আছে যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি সমস্যা, বার্ধক্যজনিত সমস্যা ইত্যাদি কারণেও রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যাদের ডায়াবেটিস ত্রিশ বছরের আগে ধরা পড়ে এবং ইনসুলিন ছাড়া কন্ট্রোল হয় না, তাদের সাধারণ বিশ বছর পর প্রায় প্রত্যেকেরই রেটিনার সমস্যা দেখা দেয়। অপরপক্ষে যাদের ডায়াবেটিস ত্রিশ বছরের পরে ধরা পড়ে তাদের ডায়াবেটিস ধরা পড়ার সময়েই সঙ্গে সঙ্গে চোখের রেটিনা পরীক্ষা করা প্রয়োজন, কারণ তাদের শতকরা ২০ জনের কোনো না কোনো রেটিনার সমস্যা রোগ নির্ণয়ের সময় বর্তমান থাকে। এছাড়া ডায়াবেটিক রোগীর হঠাৎ করে দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে অথবা চোখের সামনে কালো কিছু ভাসতে থাকলে দ্রুত রেটিনা বিশেষজ্ঞ দেখান প্রয়োজন।
উচ্চরক্তচাপের কারণে যেমন মস্তিষ্কে অথবা হৃদযন্ত্রে স্ট্রোক হতে পারে তেমনি এটি রেটিনার রক্তনালীকেও বন্ধ করে রেটিনাতে স্ট্রোক করাতে পারে। তাই উচ্চরক্তচাপজনিত ব্যক্তি হঠাৎ করে চোখে কম দেখলে রেটিনা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হওয়া আবশ্যক।
বার্ধক্যজনিত শরীরে অন্যসব অঙ্গের মতো রেটিনা রোগাক্রান্ত করে। ছানি অথবা চোখের উচ্চচাপজনিত কোনো কারণ না থাকলে এবং চশমার দ্বারা দৃষ্টিশক্তির উন্নতি না হলেও চোখে আকা বাঁকা এবং অস্পষ্ট দেখা অথবা কোনো ব্যক্তির দৃষ্টিশক্তি ক্রমাগতভাবে ধীরে ধীরে কমতে থাকলে রেটিনাতে সমস্যা হয়েছে বলে ধারণা করা যেতে পারে।
পরিশেষে, রেটিনা রোগীদের সব ধরনের পরীক্ষা যেমন চোখের এনজিওগ্রাম, চোখের স্ক্যান এবং চিকিৎসা যেমন রেটিনার অস্ত্রপচার, লেজার এবং বিভিন্ন ধরনের বিদেশি উন্নতমানের ইনজেকশন বর্তমানে বাংলাদেশে হয়ে থাকে। এ ধরনের চিকিৎসা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, বারডেম হাসপাতাল এবং ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালসহ কিছু বে-সরকারি হাসপাতালে বিদ্যমান আছে। রেটিনা রোগীদের সচেতনতা বিদ্যমান রেটিনা চিকিৎসার সুবিধাকে গ্রহণ করে অন্ধত্ব থেকে মুক্ত তথা সবল দৃষ্টিশক্তি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
ডা. দীপক কুমার নাগ
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (রেটিনা বিভাগ), জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।