অস্থিসন্ধি ক্ষয়ের চিকিৎসা ও প্রতিকার
ঝড়তি পড়তি আথ্রাইটিস। হাডের গিট ব্যবহারে ক্ষয়। অস্থিসন্ধি ক্ষয়, অবক্ষয়। হাড়ের গিটের অভিঘাত শোষকের ক্রমান্বয়ে ক্ষয় হলে হয় অস্টিওআথ্রাইটিস। হাটতে চলতে খেলতে হাড়ের গিটে যে অভিঘাত পড়ে একে শুষে নেবার জন্য উপায় রয়েছে। গিঁটে ক্রমান্বয়ে তা ক্ষয় হতে থাকে আর সেজন্য এ সমস্যা। আক্রান্ত হাড়ের গিট যখন আমরা ব্যবহার করি- কোমর ভাঁজ করে বসি বা হাঁটু ভাজ করে বসি তখন ব্যথা হয় খুব। শব্দাবলী টাইপ করলে আঙ্গুল ব্যথা করে। ৬০ উর্দ্ধ অনেক লোকের হয় অস্টিওআথ্রাইটিস। তবে আরও তরুণ বয়সেও হতে পারে।
উপসর্গ: উপসর্গ শুরু হয় ক্রমে ক্রমে, ধীরে ধীরে। নির্দিষ্ট কোনও অস্থিসন্ধি নড়ালে বা বেশ কয়েক দিন নিষ্ক্রীয় জীবন যাপন করার পর ব্যথাও দারুন ক্লেশ বোধ হয়। আক্রান্ত হাড়ের গিটে নিশ্চল হতে পারে। গিটে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দও হতে পারে। অস্টিওআথ্রাইটিস হলে সকালে হাড়ের গিট নিশ্চল হয়, আরাম হয় আধ ঘন্টার মধ্যে অবশ্য। অস্টিওআথ্রাইটিসে হাত আক্রমণ করলে কিছু লোকের আঙ্গুল ফুলে যায়। হতে পারে ব্যথা। আবার নাও হতে পারে।
কোথায় ব্যথা হয়: বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অস্টিওআথ্রাইটিস হয় হাটু, কোমর বা শিরদাঁড়ার ভার বহনকারী অস্থিসন্ধিগুলোতে। আঙ্গুল বুড়ো আঙ্গুল, ঘাড় এবং পায়ের বুড়ো আঙ্গুলেও হতে পারে। কোনও আঘাত না পেলে অন্যান্য গটে তেমন হয় না এই আথ্রাইটিস।
কেন হয় আথ্রাইটিস: প্রতিটি হাড়ের গিটে রয়েছে কোমলাস্থি। প্রাকৃতিক অভিঘাত শোষক এই কোমলাস্থি। এই দৃঢ় অথচ রাবারের মত পদার্থ হাড়ের প্রান্তদেশকে দেয় কুশনের মত সুরক্ষা। এবং সুস্থ হাড়ের গিটগুলোর মধ্যে ঘর্ষণ অনেক হ্রাস করে। আমাদের যত বয়স হয়, হাড়ের গিটগুলো কঠিন ও অনমনীয় হয়ে পড়ে। কোমলস্থিগুলো ক্ষয়ের শিকার হয় বেশি। এদিকে বছরের পর বছর ধরে হাড়ের গিটে পুন:পুন: এত বার ব্যবহার হতে হতে কোমলাস্থিগুলো হয় উত্তেজিত ও ক্ষীয়মান। যথেষ্ট অধোগতি যদি হয় তাহলে হাড়ে হাড়ে চলতে থাকে ঘর্ষণ, ফলে হয় প্রচন্ড ব্যথা, সচলতা যায় কমে।
কিছু ঝুঁকি যা নিয়ন্ত্রণ সাধ্য নয়: অস্টিওআথ্রাইটিস এর একটি ঝুঁকি যা কারো নিয়ন্ত্রণে নয় আমাদের। আর তা হলো বুড়ো হওয়া। জেন্ডারেরও একটি ভূমিকা আছে। ৫০ উর্দ্ধ হলে পুরুষের চেয় নারীদের এ রোগ হয় বেশি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বয়সের কারণে স্বাভাবিক ক্ষয় অধোগতির কারণেই তো হয় এ রোগ। কোনও কোনও লোকের থাকে জীনগত ত্রুটি বা হাড়ের গিটে অসংগতি যে জন্য এরোগে আক্রান্ত হয় বেশী করে।
যে ঝুঁকিগুলো নিয়ন্ত্রণ সাধ্য: আহত, আঘাত প্রাপ্ত অস্থিসন্ধিগুলোর যেহেতু অস্টিওআথ্রাইটিস হবার থাকে বেশি সম্ভাবনা। তাই হাড়ের গিট আহত হয় এমন যে কোনও কিছু করলে ঝুঁকি বাড়বেই। যেমন এমন খেলাধূলা যেগুলোতে আহত হবার খুব বেশি ঝুঁকি বা এমন কোনও কাজ যার জন্য বারবার হাটু নুইতে হয়, এসব তো এড়ানো যেতে পারে। স্থূলতা আর একটি ঝুঁকি যা নিয়ন্ত্রণ সাধ্য। হাটু ও কোমরের অস্টিওআথ্রাইটিসের সঙ্গে স্থূলতা বেশ সম্পর্কিত।
দৈনন্দিন জীবনে এর প্রভাব: অস্টিওআথ্রাইটিস প্রতিটি ব্যক্তিকে প্রভাবিত করে ভিন্ন ভিন্নভাবে। অস্থিসন্ধিদের যথেষ্ট ক্ষয় সত্বেও অনেকের উপসর্গ থাকে সামান্য। অন্যদের হয় অনেক ব্যথা, গিট থাকে অনমনীয় যা দৈনন্দিন কাজ ব্যহত হয়। আঙ্গুলের ছোট ছোট গিটে যদি হাড়ের গুটি দেখা যায় তাহলে শার্টের বোতাম লাগানোর মত কাজ দু:সাধ্য হয়ে পড়ে। হাটু বা কোমরের অস্টিওআথ্রাইটিসের জন্য অনেক সময় খুঁড়িয়ে হাটতে হয়। শিরদাঁড়ায় হলে বেশ ব্যথা হয়, অবশও লাগতে পারে।
অস্টিওআথ্রাইটিস নির্ণয়: ডাক্তারকে সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য রোগীর সহায়তা প্রয়োজন। উপসর্গ বিশদভাবে বর্ণনা করা চাই। ব্যথা কোথায় হচ্ছে, কতবার হচ্ছে। ডাক্তার আক্রান্ত গিটগুলো পরীক্ষা করবেন। কতটুকু ক্ষতি হলো তা বোঝার জন্য বা হাড়ের গিটের অন্যান্য রোগ বাদ দেওয়ার জন্য এক্সরে ও অন্যান্য ইমেজিং স্টাডির জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন। রক্ত পরীক্ষা প্রয়োজন হতে পারে অন্যান্য ধরণের আথ্রাইটিস আছে কিনা তা যাচাই করার জন্য।
দীর্ঘ মেয়াদী জটিলতা:রিউমাটয়েড আথ্রাইটিসের মতো, অস্টিওআথ্রাইটিস দেহের কোন অঙ্গ বা যন্ত্রের উপর প্রভাব ফেলেনা বা রোগও ঘটায়না। তবে দীর্ঘ মেয়াদে হতে পারে অঙ্গের বিকৃতি, কিছুটা পঙ্গুত্ব, মানুষের সচলতা, চলাফেরা এতে ব্যহত হতে পারে। হাটুতে কোমলস্থি খুব বেশি ক্ষয় হলে হাটু বেকে গিয়ে ধনুকের আকৃতি নিতে পারে। শিরদাড়া বরাবর হাড়ের কাঁটা স্নায়ুকে উত্তেজিত করতে পারে, শরীরের কোনও অংশে হয় প্রচন্ড ব্যথা, অবশভাব বা ঝিনিঝন্ অনুভূত হতে পারে।
চিকিত্সা ও ফিজিক্যাল থেরাপি: হাড়ের গিটের কোমলাস্থির ক্ষয় রোধ করার কোনও চিকিত্সা নেই তবে হাড়ের গিটের কাজ-কর্ম, সচলতা বাড়ানোর চেষ্টা চলতেই পারে। একটি হলো ফিজিক্যাল থেরাপি। আক্রান্ত অস্থিসন্ধির চারপাশের পেশীগুলোর নমনীয়তা বাড়াতে এবং একে আরো সবল করার জন্য প্রয়োজন ফিজিওথেরাপি। ব্যথা উপশমের জন্য থেরাপিস্ট দিতে পারেন হট ও কোল্ড থেরাপিও।
অবলম্বন কৌশল: সাপোর্টিং ডিভাইস যেমন ফিংগার স্পিন্ট বা হাটুর ব্রেস কমাতে পারে হাড়ের গিটের উপর চাপ এবং ব্যথাও নিরাময় হতে পারে। হাটতে খুব কষ্ট হলে বেতের লাঠি, ক্র্যচ বা ওয়াকিং স্টিক সহায়ক হতে পারে। যাদের শিরদাড়ায় অস্টিওআথ্রাইটিস আছে তারা পিঠে ব্রেস পড়লে বা নেক কলার পড়লে বা শক্ত বিছানায় শুলে আরাম হতে পারে।
ওষুধ: অস্টিওআথ্রাইটিস প্রবল হলে অনেকে ব্যথার ওষুধ, প্রদাহরোধী ওষুধ যেমন এসপিরিন, ইবুপ্রুফেন ও এসিটোত্রমিনোফেন গ্রহণ করে আরাম পেতে পারেন। ব্যথা উপশমক ক্রিম ব্যবহার করে একটু আরাম বোধ হতে পারে। এতেও ভালো না হলে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে। স্টেরয়েড বা হাইলুরোনান ইনজেকশন প্রয়োজন হতেও পারে।
সাপ্লিমেন্ট: গ্লুকোসেমাইন ও কনড্রয়াটিন সাপ্লিমেন্টে সুফল আসে কখনও কখনও। তবে তা ডাক্তারের পরামর্শে হওয়া চাই।
অস্টিওআথ্রাইটিস ও দেহ ওজন: দেহ ভারি হলে বা স্থূল হলে হাটু বা কোমরে অস্টিওআথ্রাইটিস উপশমের শ্রেষ্ট উপায় হলো দেহের কিছু ওজন ঝরানো। এমনকি মাধ্যম ওজন হ্রাস করা হলেও সুফল পাওয়া যায়। হাড়ের গিটের উপর ভার কমলে আরাম লাগবে। দেহের ভার কমালে কেবল ব্যথাই আরাম হয় না, দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতিও প্রতিরোধ করা যায়।
অস্টিওআথ্রাইটিস ও ব্যায়াম: যাদের অস্টিওআথ্রাইটিস তারা ব্যায়াম করতে উদ্বিগ্ন বোধ করেন। মনে করেন এতে হয়ত ব্যথা বেড়ে যাবে। তবে কম ধকল ব্যায়াম যেমন সাঁতার কাটা, হাঁটা বা বাইসাইকেল চালানো সচলতা বাড়াতে পারে। বল শক্তি বাড়াতে পারে। হালকা ভারউত্তোলনও করা যেতে পারে।
সার্জারি কার জন্য: অস্টিওআথ্রাইটিস যদি দৈনন্দিন জীবনকে বিপর্যস্ত করে, ফিজিক্যাল থেরাপি বা ওষুধে যদি কাজ না হয় তাহলে অস্থিসন্ধি প্রতিস্থাপন হতে পারে বিবেচ্য চিকিত্সা। হাটু ও নিতম্বের অস্থি প্রতিস্থাপনও হয় বেশি।
প্রতিরোধ করা যায়: অস্টিওআথ্রাইটিস প্রতিরোধের শ্রেষ্ট উপায় হলো শরীরের যথাযথ ওজন বজায় রাখা। বছরের পর বছর ধরে বাড়তি ওজন বাড়ের গিটের উপর অতিরিক্ত চাপ ফেলে। ফলে হাড়ের গিটের স্বাভাবিক গঠনও বদলে দিতে পারে। আঘাত লাগা, আহত হওয়া ঠেকাতে হবে। কর্মস্থলে কাজ, খেলাধূলা এসব ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। নিরাপদ জীবন যাপন করতে পারে। আঘাত লাগে, আহত হওয়া যায় এমন কাজ ও খেলাধূলা পরিহার করতে হবে।
অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী
পরিচালক, ল্যাবরেটরী সার্ভিসেস
বারডেম, ঢাকা