রোহান, বয়স ৯ বছর -এই ছেলেটির প্রায়ই পা ব্যথা করে, বিশেষ করে পায়ের মাংসপেশিগুলোতে বেশি ব্যথা করে। যেদিন বেশি হাঁটাহাঁটি হয় কিংবা স্কুলে খেলাধুলা করে -সেই দিন সমস্যাটি বেড়ে যায়। এটি প্রথম দেখা দেয় ৩ বছর আগে, তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তিনি কিছু পরীক্ষা করান, এর মধ্যে এ এস ও টাইটার বেশি পেলে বাতজ্বর হয়েছে বলে প্রতি মাসে মাংসে পেনিসিলিন ইঞ্জেকশন নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়।
সেই থেকে প্রতি মাসে ইঞ্জেকশন নিচ্ছে, তার পরও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। তাই তার মায়ের মনে প্রশ্ন এত ইঞ্জেকশন নিচ্ছে তার পরও কেন পায়ে ব্যথা? রোহানের মতো অনেক ছেলেমেয়েরা এরকম পায়ে-হাতে ব্যথার জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে তারা কিছু পরীক্ষা করান আর এই টাইটার বেশি পেলে বাতজ্বর আখ্যা দিয়ে বছরের পর বছর পেনিসিলিন ট্যাবলেট কিংবা ইঞ্জেকশন দিতে থাকেন।
পরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে অনেকের বাতজ্বর ভুল প্রমাণিত হয়, তবে এই চিকিৎসায় শিশুটির শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি অনেক অর্থ এবং সময় অযথা নষ্ট হয়ে যায়।
তাহলেআসুনজেনেনিইবাতজ্বরকী?
বাতজ্বর কে ইংরেজিতে বলে রিউমেটিক ফিভার। এটা বাচ্চাদের একটি প্রদাহজনিত রোগ। গলায় স্ট্রেপটোকক্কাস নামের অনুজীবের সংক্রমণের পর তার বিরুদ্ধে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয় তা আবার হৃৎপিণ্ড, ব্রেইন, পিঠ, চামড়া ইত্যাদি স্থানের টিস্যুকে আক্রমণ করে প্রদাহজনিত রোগের সৃষ্টি করে।
বাতজ্বরেঝুঁকিপূর্ণকারা?
এটা সাধারণত ৫ থেকে ১৫ বছর বয়সের বাচ্চাদের বেশি হয়। স্কুলের ছাত্রছাত্রী দলবদ্ধ হয়ে থাকা, কিংবা ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে বসবাস করলে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে স্ট্রেপটোকক্কাস দিয়ে গলা ব্যথাজাতীয় রোগ হওয়ার ৭/৯ দিনের মধ্যে এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা শুরু করলে বাতজ্বর হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।
বাতজ্বরহলেবুঝবেনকীকরে?
আগেই বলা হয়েছে এই বাতজ্বর ব্রেইন, হৃৎপিণ্ড, পিঠ, চামড়া ইত্যাদি অনেক স্থানকে আক্রমণ করে। তাই কোনো একক লক্ষণ কিংবা পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তাররা এটা নিশ্চিতভাবে নির্ণয় করতে পারেন না। তাই অনেক গবেষণার পর একজন বিজ্ঞানী এটা নির্ণয়ের যে বৈশিষ্ট্য ঠিক করে দিয়েছেন তার নামানুসারে সেটা জোন্স নির্ণায়ক এবং কিছু পরিবর্তন হয়ে বর্তমানে পরিবর্তিত জোন্স মানদণ্ড নামে পরিচিত।
এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে তিনি ৫টি মুখ্য এবং কিছু গৌণ বৈশিষ্ট্য রেখেছেন। সেইসঙ্গে থাকতে হবে স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণের প্রমাণ। মুখ্য বৈশিষ্ট্যের যেকোনো দুটি অথবা একটি মুখ্যর সঙ্গে দুটি গৌণ বৈশিষ্ট্য এবং সম্প্রতি স্ট্রেপটোকক্কাস সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া গেলে তাকে বাতজ্বর হিসেবে ধরতে হবে অন্যথায় নয় ।
বাতজ্বরেরমুখ্যবৈশিষ্ট্যগুলোহলো-
১. হৃৎপিণ্ডের প্রদাহ
২. হাত ও পায়ের বিভিন্ন জয়েন্টে প্রদাহ
৩. ব্রেইন প্রদাহজনিত কাঁপুনি-খিঁচুনি
৪. চামড়ার লাল দাগ
৫. চামড়ার নিচে আরও গৌণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে থাকতে পারে হাতে-পায়ে হালকা ব্যথা, জ্বর বেড়ে যাওয়া এবং দৈর্ঘ্য বেড়ে যাওয়া। তবে এদের সঙ্গে অবশ্যই সম্প্রতি সংক্রমণের প্রমাণ হিসেবে গলা পরীক্ষায় জীবাণুর অস্তিত্ব, বাড়তি টাইটার থাকতে হবে।
গৌণবৈশিষ্ট্যেরকিছুধারণা
১. হৃৎপিণ্ড প্রদাহ শতকরা ৪০/৮০ ভাগ বাচ্চার এটা হতে পারে, হৃৎপিণ্ডের কম্পন বেড়ে যাওয়া এবং হৃৎপিণ্ড বড় হয়ে যাওয়া, অনিয়মিত স্পন্দন বাড়তি হৃৎ কম্পন দেখেও ডাক্তাররা এটা নির্ণয় করতে পারেন।
২. শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর পায়ের হাতের বড় বড় জয়েন্টে এই প্রদাহ থাকতে পারে। যার ফলে জয়েন্টগুলো ব্যথা করে ও ফুলে যায়। সাধারণত মাংসপেশিতে ব্যথা করে না।
তাই মনে রাখতে হবে, পায়ে ব্যথা কিংবা পায়ের মাংস ব্যথা হলেই বাতজ্বর এমনটি ঠিক নয়।
তবে প্রাথমিকভাবে শিশুর সারাদিনের দৌড়াদৌড়ি, লাফালাফি ও খেলাধুলাকে এজন্য দায়ী বলে মনে করা হয়। সাধারণত তিন বা চার বছর বয়স থেকে শিশুর গ্রয়িং পেইন শুরু হয় এবং আট থেকে বারো বছর বয়স পর্যন্ত সে এই ব্যথা অনুভব করে। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ব্যথার মাত্রা কমে যায় বা ব্যথা আর হয় না। শিশুর গ্রয়িং পেইন তার দীর্ঘমেয়াদি কোনো ক্ষতি করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রয়িং পেইনের ব্যথা শিশুর উরুর সামনের বা পায়ের পেছনের মাংসপেশিতে হয়। কখনও কখনও হাতেও ব্যথা হতে পারে। তবে কখনোই এই ব্যথা হাত-পায়ের কোনো গিরাকে আক্রমণ করে না। শিশুর গ্রয়িং পেইনের ব্যথা কমানোর জন্য তার পায়ের মাংসপেশির কিছু ব্যায়াম করতে হবে পাশাপাশি হালকা গরম করে সেক দেয়া যেতে পারে। তাই শিশুর পায়ে ব্যথা হলে অবহেলা না করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিতে হবে।
ডা. এম ইয়াছিন আলী
বাত, ব্যথা, প্যারালাইসিস ও ফিজিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ
চেয়ারম্যান ও চিফ কনসালটেন্ট
ঢাকা সিটি ফিজিওথেরাপি হাসপাতাল, ধানমণ্ডি, ঢাকা ।