ডায়াবেটিস রোগীর খাবার-দাবার (৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস)
ডায়াবেটিস রোগ হওয়ামাত্র মানুষের মনে প্রথম প্রশ্ন তৈরি হয়- আমি আর ভালো ভালো খাবার খেতে পারব না। যারা এমন মনোভাব পোষণ করেন, তাদের উদ্দেশেই মূলত এ লেখা। প্রথম বিষয় হলো, ডায়াবেটিস কোনো খাবার খাওয়া বা না খাওয়ার জন্য হয় না। শুধু শরীরে ইনসুলিনের অভাবে হয়। ডায়াবেটিস হওয়ার পর প্রথম সম্পর্ক খাবারের সঙ্গে। যেহেতু ইনসুলিনের অভাব হলে খাবার থেকে তৈরি হওয়া চিনি বা গ্লুকোজ রক্তে বেড়ে যায়, তাই খাবারটা এমনভাবে খেতে হবে, যাতে রক্তে কম চিনি তৈরি হয়। অর্থাৎ শর্করা জাতীয় খাবার (চিনি, মিষ্টি, চাল ও আটার তৈরি খাবার) পরিমাণ মতো বা কিছুটা কম খেতে হবে। কারণ শর্করা জাতীয় খাবার থেকেই মূলত চিনি তৈরি হয়। শর্করা প্রধানত দুই ধরনের। সহজ শর্করা ও জটিল শর্করা। সহজ শর্করা খাবার চিনি হিসেবেই থাকে। খেতে মিষ্টি স্বাদের হয়। এসব খাবার গ্রহণের পরপরই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায়। শুধু এ কারণেই ডায়াবেটিস আক্রান্তকে সরাসরি এই গ্রুপের খাবার অর্থাৎ চিনি, গুড়, মধু, মিষ্টি, ড্রিংক, জুস, কনডেন্স মিল্ক্ক জাতীয় খাবার বাদ দিতে বলা হয়। একজন ডায়াবেটিস আক্রান্তের সঙ্গে সুস্থ ব্যক্তির খাবারের পার্থক্য এতটুকুই।
অন্যদিকে জটিল শর্করা গ্রুপের খাবারের সঙ্গে চিনি লুকিয়ে থাকে। খাওয়ার পর ধীরে ধীরে সময় নিয়ে রক্তে চিনির পরিমাণ বাড়তে থাকে। ফলে এ গ্রুপের খাবার যদি অনেক বেশি পরিমাণে একবারে না খেয়ে বারবার, পরিমাণে ভাগ করে খাওয়া হয়, তাহলে রক্তের চিনি নিয়ন্ত্রণে রাখা খুব সহজ হয়। পাশাপাশি শরীর তার প্রয়োজনীয় শক্তি বা উৎসগুলো পেয়ে যায় ও দুর্বলতা তৈরি হয় না। এ গ্রুপের খাবারের মধ্যে ভাত, রুটি, মুড়ি, চিড়া, খৈ, নুডলস, ওটস, আলু, সুজি, সেমাই, কর্নফ্লেক্স, ব্রেড, বন ইত্যাদি অন্যতম। এ শর্করা জাতীয় খাবারের পাশাপাশি একজন সুস্থ ব্যক্তি চাহিদা অনুযায়ী আমিষ জাতীয় খাবার মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, ভিটামিন ও মিনারেল জাতীয় খাবার অর্থাৎ শাকসবজি, সালাদ, ফল এবং তেল খেতে পারবেন।
ডায়াবেটিস আক্রান্তের জন্য দ্বিতীয় বিষয় হলো খাবারের সময়। দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে রক্তের চিনি কমে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ কারণে ডায়াবেটিস ব্যক্তির খাবার হতে হবে তিন ঘণ্টা পরপর দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার। এ সময়টা কাজের ধরন ও পছন্দ অনুযায়ী নিজেই ঠিক করে নিতে হবে। তবে যারা রাতে কাজ করবেন তাদের অবশ্যই তিন ঘণ্টা পরপর খেতে হবে। তৃতীয় বিষয় হলো খাবারের পরিমাণ। একজন সুস্থ ব্যক্তির মতোই ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির খাবারের পরিমাণ নির্ভর করে ওই ব্যক্তির বয়স, উচ্চতা, ওজন, কাজের ধরন, পরিশ্রমের মাত্রার ওপর। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কোনো খাবার একই পরিমাণে প্রতিদিন খেতে হবে। পরিমাণের তারতম্য করলে রক্তে চিনির মাত্রাও ওঠানামা করবে। তাই একজন ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য ব্যবস্থাপনায় তিনটি বিষয় লক্ষ্য রাখতে হবে। তা হলো- তিন ঘণ্টা পরপর সময় মতো খাবার গ্রহণ, একই খাবার ও একই পরিমাণে শরীরের চাহিদা অনুযায়ী খাওয়া। তবে যাদের চিকিৎসায় ওষুধ বা ইনসুলিন থাকবে, তাদের অবশ্যই ওইসব ওষুধ বা ইনসুলিনের সঙ্গে খাবারের সম্পর্কের বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। যেমন- কোনো ওষুধ সেবনের ৩০ মিনিট পর খাবার গ্রহণের কথা বলা হলে ওই সময়ই খাবার খেতে হবে। বিশেষ করে যারা রাতে বিলম্ব করে ঘুমান তাদের জন্য ঘুমানোর আগে হালকা খাবার যেমন- এক কাপ দুধ বা সমপরিমাণ খাবার খেতে হবে। যাতে ঘুমের মধ্যে বা ভোরবেলা হাইপো না হয়। জীবনযাপন, খাদ্য ব্যবস্থাপনা, ওষুধ বা ইনসুলিনের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে সচেতনভাবে কেউ নিয়ম-কানুন মেনে চলতে পারলে ডায়াবেটিসের জটিলতা প্রতিরোধ করে সুস্থ-স্বাভাবিক, কর্মক্ষম ও দীর্ঘ জীবনযাপন করা সম্ভব।
শামসুন্নাহার নাহিদ
প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান
পুষ্টি বিভাগ, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল