এমদাদ সাহেবের বয়স ৫০ হয়েছে। ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে বছর পাঁচেক হল। ইনসুলিন নেন না। ওষুধ খান। খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। সব সময় পারেন না। ধূমপান করতেন এক সময়, এখন অনেক কমিয়ে এনেছেন, পুরোপুরি ছাড়তে পারেননি। নিয়মিত হাঁটার কাজটাও অনিয়মিত। এই হাঁটার কাজটাতে ইদানীং সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। আগে একটানা ৩০-৪০ মিনিট হাঁটতে পারতেন। এখন ১০ মিনিট হাঁটলেই পা কেমন যেন অবশ হয়ে আসে। একটু দাঁড়িয়ে নিলে অবশ্য আবারো হাঁটা যায়। হাঁটার এই সমস্যার কারণে ডায়াবেটিসও বেড়ে যাচ্ছে। মাসখানেক আগে নতুন একজোড়া জুতা কিনেছিলেন হাঁটার জন্য। একটু শক্ত শক্ত লাগছিল। তা নতুন জুতো একটু শক্ত লাগতেই পারে, কিছুদিন পরলে ঠিক হয়ে যাবে- এই ভেবে জুতো পায়ে হাঁটতে বের হলেন এমদাদ সাহেব। বাসায় ফিরে জুতো খুলে দেখেন বাম পায়ের বুড়ো আঙুলের মাথায় একটা ফোস্কা। এটা আবার কখন হল, কোনো ব্যথা তো টের পাননি। তাহলে? প্রায় এক মাস হল সেই ফোস্কার চিকিৎসা চলছে। অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথার ওষুধ, ডায়াবেটিসের ওষুধ- সবই নিয়ম মাফিক খাচ্ছেন। কিন্তু ফোস্কা কিছুতেই শুকাচ্ছে না। উল্টো ক্ষত বড় হয়ে যাচ্ছে এবং আঙুলের মাথাটা কেমন যেন কালো কালো হয়ে উঠছে। সেদিন ডায়াবেটিস হাসপাতাল থেকে তাকে পাঠানো হল ভাস্কুলার ডুপ্লেক্স নামের এক পরীক্ষার জন্য। সেই পরীক্ষায় ধরা পড়ল তার পায়ের রক্তনালীতে নাকি ব্লক। ব্লকের কারণে পায়ের আঙুলে ঠিকমতো রক্ত আসতে পারছে না, তাই ক্ষত শুকাচ্ছে না। রোগের নাম পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজ। এই রোগের চিকিৎসার জন্য এমদাদ সাহেবকে ঢাকার জাতীয় হুদরোগ হাসপাতালের ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগে রেফার করা হয়েছে।
পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজ কী
ধমনি যেহেতু শরীরের সব জায়গাতেই ছড়িয়ে আছে, ধমনির ব্লকও যে কোনো জায়গাতেই হতে পারে। হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্ক ছাড়া শরীরের অন্য অংশের ধমনির যে ‘ব্লক’ সেটাই ‘পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজ’ বা ‘পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজ’। একে ‘ক্রনিক লিম্ব ইশকেমিয়া’ নামেও অভিহিত করা হয়। পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজে আক্রান্ত রোগীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে পায়ের ধমনিতে ব্লকের সমস্যা নিয়ে আসেন। মনে রাখতে হবে, শরীরের অন্যান্য অংশে বিশেষ করে হাতের বা পেটের মধ্যের ধমনির ব্লকের ঘটনা মোটেও বিরল নয়।
ব্লক কেন হয়
করোনারি ধমনির মতোই হাত বা পায়ের ধমনির ভেতরে রক্তের প্রবাহপথ সরু বা বন্ধ হয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল ধমনির ভেতরের দেয়ালে কোলেস্টেরল বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমা হওয়া। স্বাভাবিকভাবেই রক্তের প্রবাহপথ সরু বা বন্ধ হয়ে গেলে তার পরবর্তী অংশে বিভিন্ন ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়।
পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজের লক্ষণ
পায়ের ধমনিতে ব্লক সৃষ্টি হলে প্রাথমিক অবস্থায় হাঁটতে গেলে পায়ের মাংসপেশীতে খিঁচ ধরে আসে। একে বলে ইন্টারমিটেন্ট ক্লডিকেশন (Intermittent Claudication)। কিছুক্ষণ বিশ্রাম না নিলে আর হাঁটা যায় না। আস্তে আস্তে ব্যথার মধ্যবর্তী হাঁটার দূরত্ব বা ক্লডিকেশন ডিসট্যান্স (Claudication Distance) কমতে থাকে ও এক পর্যায়ে ব্যথা শুধু হাঁটার সময়েই নয়, সব সময় থাকে। একে বলে রেস্ট পেইন (Rest Pain)। এমনকি ব্যথার কারণে রাতে ঘুম হয় না।
আক্রান্ত পা দিন দিন শুকিয়ে আসতে থাকে ও তাতে লোমের সংখ্যা কমে যেতে থাকে।
ব্যথার ধারাবাহিকতায় একসময় পায়ে ঘা বা গ্যাংগ্রিন হয়, যা কিছুতেই শুকাতে চায় না।
সময়মতো চিকিৎসা না করালে অল্প সময়ের মধ্যে আক্রান্ত অংশ স্থায়ীভাবে অকেজো হয়ে যেতে পারে এবং আক্রান্ত অংশে জীবাণু সংক্রমণজনিত কারণে জীবন বিপন্ন হতে পারে। অনেক সময় আক্রান্ত পায়ের অংশ কেটে বাদ দিতে হয়।
পেটের মধ্যকার বড় ধমনিতেও (মহাধমনি) ব্লক সৃষ্টি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে হাঁটলে পায়ের সঙ্গে সঙ্গে উরু ও নিতম্বে ব্যথা এবং ক্ষেত্রবিশেষে যৌন অক্ষমতা দেখা দিতে পারে।
যারা ধূমপায়ী, যাদের রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেশি এবং যারা ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন- হার্টের ধমনিতে ব্লক বা ইশকেমিক হার্ট ডিজিজের মতো তাদের পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি। সাধারণত যাদের বয়স ৫৫ বা তার বেশি, তাদের শতকরা ১০-২৫ ভাগ পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজে আক্রান্ত, যদিও এদের অনেকেই ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না। পঞ্চাশোর্ধ্ব প্রতি তিনজন ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে একজন এই রোগে ভুগছেন। বয়স্কদের মতো অল্পবয়সীরাও পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজে আক্রান্ত হতে পারেন। আমাদের দেশে ইদানীং ২০-৩০ বছর বয়সীদের মাঝেও এই রোগে আক্রান্ত রোগী দেখা যাচ্ছে। মহিলাদের তুলনায় পুরুষরা এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের রোগীদের মধ্যেও এই রোগ বেশি লক্ষ্য করা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে ইশকেমিক হার্ট ডিজিজে আক্রান্ত প্রতি ১০০ জন রোগীর মধ্যে ৫০ জন পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজে আক্রান্ত। স্ট্রোকের রোগীদের ক্ষেত্রেও এই আশংকা সাধারণ মানুষের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।
কী করবেন
ইশ্কেমিক হার্ট ডিজিজের মতোই জীবনাচরণে পরিবর্তন যেমন- ধূমপান পরিত্যাগ এবং উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও রক্তের কোলেস্টেরলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা পেরিফেরাল আর্টারিয়াল ডিজিজ নিয়ন্ত্রণের অন্যতম পূর্বশর্ত। এর সঙ্গে রোগের প্রাথমিক অবস্থায় নিয়মিত কিছু ওষুধ সেবনে উপকার পাওয়া যায়। এ পর্যায়ে নিয়মিত হাঁটা অথবা চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ‘সুপারভাইজড এক্সারসাইজ থেরাপি’ বেশ ফলপ্রসূ হয়। কিন্তু রোগ যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ ধমনিতে ব্লকের কারণে রক্তপ্রবাহ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়, তখন করোনারি ধমনির মতোই ব্লক দূর করার জন্য রিং বসানো (অ্যানজিওপ্লাস্টি) বা বাইপাস অপারেশনের মতো আধুনিক চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে। এ ধরনের অপারেশনের আগে রক্তনালীর আলট্রাসাউন্ড (ভাস্কুলার ডুপ্লেক্স স্টাডি) এবং অ্যানজিওগ্রাম পরীক্ষার মাধ্যমে ব্লকের স্থান ও এর তীব্রতা নির্ধারণ করা হয়।
ডা. আবুল হাসান মুহম্মদ বাশার
সহযোগী অধ্যাপক,
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা