দীর্ঘ নয় বছর ধরে প্রসবজনিত ফিস্টুলায় ভুগেছেন ২৮ বছর বয়সী ফাতেমা। নরসিংদীর মেয়ে ফাতেমা দুবার মা হতে গিয়ে দুবারই মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন প্রসবকালীন ফিস্টুলায়। এর পেছনের কারণ বিলম্বিত প্রসব। প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত হওয়ায় অবসান ঘটেছে তাঁর ১৩ বছরের সংসারজীবনের। ফিস্টুলা রোগীর সঙ্গে কোনোভাবেই ঘরে করতে রাজি হননি ফাতেমার স্বামী।
আরেকটি ঘটনা। ২৭ বছর বয়সী ঝুমুর বেগমের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলায়। তাঁর আছে ১২ ও ৯ বছর বয়সী দুটি মেয়ে। তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত হন তিনি। প্রসবের সময় সন্তানটিও মারা যায়। এরপর তার ঠাঁই হয়েছে বাবার বাড়িতে। স্বামী কোনো খোঁজ নেন না। মেয়ে দুটি নানার বাড়িতে থেকেই পড়ালেখা করছে।
ফাতেমা ও ঝুমুরের সঙ্গে কথা হয় প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসনকেন্দ্রে। ফাতেমা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জাতীয় ফিস্টুলা কেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়ে এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আর ঝুমুর এসেছেন কয়েক দিন আগে। তাঁরও চিকিৎসা শুরু হয়েছে।
২০০৬ সাল থেকে ইউএনএফপিএর আর্থিক সহায়তায়, বাংলাদেশ সরকার এর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় বিডব্লিউএইচসির ব্যবস্থাপনায় দরিদ্র প্রসবজনিত ফিস্টুলা রোগীদের প্রশিক্ষণ ও পুনর্বাসন প্রকল্প শুরু হয়। এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের মাতৃমৃত্যু রোধ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার মান উন্নয়ন করা।
ফাতেমা ও ঝুমুরের মতো অনেক পুনর্বাসিত ফিস্টুলা রোগী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে অন্য কোনো মা যেন এই রোগে আক্রান্ত না হন, সেই লক্ষ্যে কমিউনিটি ফিস্টুলা অ্যাডভোকেট হিসেবে প্রসবজনিত ফিস্টুলা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করে যাচ্ছেন।
মাতৃস্বাস্থ্য উন্নয়নে বাংলাদেশ সাফল্য অর্জন করলেও প্রতি লাখ জীবিত জন্মে এখনো ১৭০ জন মা মারা যাচ্ছেন। প্রতিবছর গর্ভ ও প্রসবের কারণে প্রায় ৫ হাজার ২০০ জন নারীর মৃত্যু হয়। ইউএনএফপিএর আর্থিক সহযোগিতায় পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রসবজনিত ফিস্টুলায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৬৯।
ফিস্টুলায় আক্রান্ত ঝুমুর জানান, বিকেল চারটার দিকে তাঁর প্রসবব্যথা উঠলেও পরের দিন বেলা ১১টার দিকে মৃত বাচ্চার জন্ম হয়। সারা রাত ধরে গ্রামের দাই প্রসবের কাজ সঠিকভাবে না পারলেও তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি।স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসবের কারণে মূলত বেশির ভাগ প্রসবজনিত ফিস্টুলার সৃষ্টি হয়। বিলম্বিত প্রসবের সময় বাচ্চার মাথা ৩ থেকে ১২ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে যোনিপথে আটকে থাকলে পেছনের ও সামনের দুই হাড়ের মাঝের আশপাশের মাংসপেশি, যেমন: মূত্রথলি ও কোনো কোনো সময় পায়ুপথে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে এই সব মাংসপেশিতে পচন ধরে এবং শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সেখানে ছিদ্র হয়ে ফিস্টুলার সৃষ্টি হয়। যার ফলে মাসিকের রাস্তা দিয়ে অনবরত প্রস্রাব-পায়খানা ঝরতে থাকে।
প্রসবজনিত ফিস্টুলার জন্য উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হচ্ছে:
. বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্ত প্রসব।
. অদক্ষ দাইয়ের হাতে সন্তান প্রসব।
. প্রসূতির পুষ্টিহীনতা।
. ঘন ঘন সন্তান প্রসব।
. পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ না করা।
. বাড়িতে সন্তান প্রসব।
প্রসবজনিত ফিস্টুলার আরেকটি অন্যতম কারণ হলো জরুরি প্রসূতিসেবাপ্রাপ্তি ও দক্ষ ধাত্রীর অভাব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে এখনো ৫৮ শতাংশ প্রসব অপ্রশিক্ষিত সেবাদানকারীর মাধ্যমে হয়ে থাকে।
চিকিৎসকদের মতে, সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু হলে প্রসবজনিত ফিস্টুলা সম্পূর্ণ নিরাময় করা যায়। ফিস্টুলায় যারা আক্রান্ত হন, তাঁরা পারিবারিক ও সামাজিকভাবে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েন। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য রোগীর অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ে। তবে অস্ত্রোপচারের পর রোগীর নিবিড় যত্ন নিতে হবে। তা না হলে রোগী সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হবেন না।
পারিবারিক ও সামাজিক কুসংস্কার এবং অহেতুক লজ্জার কারণে অনেক ফিস্টুলা রোগীই নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। যার ফলে বঞ্চিত হন চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসেবা থেকে। এই সব ভুক্তভোগীকে চিহ্নিত করার জন্য প্রসবজনিত ফিস্টুলার লক্ষণগুলোর ওপর মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ও জনগণকে সচেতন করার কর্মসূচিকে বেগবান করতে হবে।
রেফারেন্সঃ প্রঃ আঃ
©2014 Copyright by Micron Techno. All rights reserved.