ভাইরাল হেপাটাইটিস একটি জটিল ও নিরাময়যোগ্য রোগ (২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস)
ভাইরাস জনিত কারণে লিভারে প্রদাহ হলে তাকে ‘ভাইরাল হেপাটাইটিস’ বলে। হেপাটাইটিসকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। স্বল্পকালীন হেপাটাইটিস এবং দীর্ঘকালীন হেপাটাইটিস ।
যদি ৬ মাসের মধ্যে ভাল হয়ে যায় তাহলে একিউট এবং ৬ মাসের বেশী হেপাটাইটিস বিরাজমান থাকলে ক্রনিক বলা হয়। এ, বি, সি, ডি, ই এবং অন্যান্য ভাইরাস দিয়ে হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। সবগুলো ভাইরাস দিয়ে ক্রনিক হেপটাইটিস হয় না।
প্রকারভেদ: হেপাটাইটিসের প্রধান প্রকারভেদ পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে। এছাড়া ভাইরাসের ওপর ভিত্তি করেও ভাগ করা যায়। এছাড়া কোন ধরনের উপসর্গ ছাড়াও হেপাটাইটিস হতে পারে। জন্ডিসবিহীন এবং জন্ডিসসহ হেপাটাইটিস হতে পরে। তবে জন্ডিসবিহীন হেপাটাইটিসের হার বেশী। হেপাটাইটিস ছাড়াও জন্ডিস হতে পারে। অতএব হেপাটাইটিস ও জন্ডিস সমার্থক শব্দ নয়। তবে সমাজে এ দু’টো কথা সমার্থক অর্থেই প্রচলিত হয়ে আসছে যা ঠিক নয়। ভাইরাল হেপাটাইটিস বলতে সাধারণভাবে একিউট ভাইরাল হেপাটাইটিস বোঝায়।
সাধারণতঃ জন্ডিস হবার আগে ৩ থেকে ৪ দিন আগ থেকে, কখনো কখনো দু’সপ্তাহ ধরে খাবার অরুচি, বমি বমি ভাব, গা ম্যাজ ম্যাজ করা, মাথা ব্যথা, জ¦র, পাতলা পায়খানা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। এটাকে ‘প্রেড্রোমাল স্টেজ’ বলে। এর পরেই প্রথমে চোখ হলুদ হয়ে জন্ডিস দেখা দিতে পারে। এ অবস্থায় তাপমাত্রা স্বাভাবিক হতে থাকে। পেট ব্যথা চলে যায় ও ধীরে ধীরে খাবারে রুচি হতে থাকে। এ অবস্থায় লিভারটা একটু বড় থাকে। সাধারণত: ১-৪ সপ্তাহ জন্ডিস থাকার পরে ধীরে ধীরে উন্নতি হতে থাকে। শিশুদের ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নতি হয়। কখনো যদি বমি বন্ধ না হয়ে জন্ডিস বাড়তেই থাকে, রোগী যদি ঝিমাতে থাকে বা অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে এবং অস্বাভাবিক আচরণ করে তবে দ্রুত তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। এটি লিভার ফেইল্যুরের লক্ষণ।
জটিলতা:
-
একিউট লিভার ফেইল্যুর: এটি কদাচিৎ হয়ে থাকে। সাধারণত প্রথম ১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয়, কখনো কখনো জন্ডিস দেখা দেবার আগেই শুরু হয়। এ অবস্থায় রোগী ক্রমবর্ধমান হারে বমি করতে থাকে। বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলে। জন্ডিস দ্রুত বাড়তে থাকে। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হতে পারে। এ ধরনের জটিলতা অত্যন্ত মারাত্মক।
-
কোলেস্টাটিক হেপাটাইটিস: এ ধরনের জটিলতা দেখা দেয়ার ৩ সপ্তাহের মধ্যে রোগীর সারা শরীরে চুলকানি শুরু হয় ও জন্ডিস বাড়তে থাকে। এ ধরনের রোগীদের পরিণতি অত্যন্ত ভালো। ২-৬ মাসের মধ্যে রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। ৫-১৫% রোগীদের সুস্থ হবার পর আবার জন্ডিস বাড়তে ও অন্যান্য উপসর্গ পুনরায় দেখা দিতে পারে। সাধারণত: এ ভাইরাসের ক্ষেত্রে যথাযথ বিশ্রাম না নিলে এ রকম হয়ে থাকে। এটি কোন খারাপ লক্ষণ নয়। এটা থেকে সাধারণত: পূর্ণ নিরাময় হয়ে থাকে।
রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা: ভাইরাল হেপাটাইটিসে রক্তে বিলিরুবিন, ট্রান্স-এ্যামাইনেস, এ্যালকালাইন, ফসফেটেস, প্রোথ্রোমবিন টাইম ইত্যাদি করা প্রয়োজন। এগুলো সপ্তাহান্তে পুণরায় করা জরুরী। কারণ নির্ণয়ের জন্য ভাইরাসের টেস্ট ও আলট্রাসনোগ্রাম শুরুতেই করে নেয়া প্রয়োজন। রক্তের অন্যান্য পরীক্ষাও জরুরী হতে পারে।
চিকিৎসায় প্রচলিত কুসংস্কার: ভাইরাল হেপাটাইটিসের চিকিৎসার ক্ষেত্রে মানুষের মধ্যে কুসংস্কার চালু রয়েছে। অনেকে মনে করেন এ রোগের বৈজ্ঞানিক চিকিৎসা নেই। তাই গ্রাম-গঞ্জে দেখা যায় তথাকথিত গ্রাম্য ডাক্তার কবিরাজের মাধ্যমে পানি পড়া, ডাব পড়া, তাবিজ, ঝাড়-ফুঁক ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটি এতোই ব্যাপক যে শিক্ষিত সচেতন মানুষরাও এই কুসংস্কার থেকে মুক্ত নন। আবার অনেকে মনে করেন জন্ডিস মানেই গরম। অতএব কোন ভাবে ঠান্ডা লাগাতে পারলে ভালো হয়ে যাবে। এ জন্য দিনে অনেকবার গোসল, বরফ প্রয়োগ, প্রচুর পরিমাণে ডাব খাওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে শরীরে ঠান্ডা লাগানোর চেষ্টা করেন। অনেকে প্রচুর পানি পান করতে থাকেন প্রস্রাবের হলুদ কমানো জন্য। জন্ডিস মানে গরম এ ধারণাটা এভাবে এসেছে যে, গরমের দিনে মানুষ ঘেমে যাবার কারণে প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। আর আমাদের শরীর থেকে সুস্থ অবস্থায়ও কিছু পরিমাণ বিলিরুবিন প্রস্রাবের
সাথে বের হয়। পানি কম পান করলে কিংবা শরীরের পানি কমে গেলে প্রস্রাব কম হয় এবং প্রস্রাবে বিলিরুবিনের ঘনত্ব বেড়ে যায়। ফলে প্রস্রাব হলুদ দেখায়। জন্ডিস হলে শরীরে বিলিরুবিন বেড়ে যায় আর প্রস্রাব ও বেশী বের হতে থাকে ফলে প্রস্রাব হলুদ হয়। পানি বেশী পান করলে প্রস্রাবে বেশী হয় এবং বিলিরুবিনের ঘনত্ব কমে যায়। পানি বেশী পানের সাথে প্রস্রাব হওয়ার সম্পর্ক, প্রস্রাব হলুদ বা সাদা হবার সম্পর্ক। কিন্তু জন্ডিস বাড়া বা কমার কোন সম্পর্ক নেই। প্রস্রাব সাদা বা হলুদ এবং কম বা বেশী যাই হোক না কেন সম পরিমাণ বিলিরুবিনই বের হবে। অতএব জন্ডিসে বেশী পানি পানে প্রচুর প্রস্রাবের তৈরী করে সমপরিমাণ বিলিরুবিনই নির্গত হবে। সাদা প্রস্রাব তৈরীর ভ্রান্ত চিন্তায় রোগীরা নিজেই নিজের সাথে প্রতারণা করছেন। প্রস্রাব থেকে পায়খানার মাধ্যমে বরং বেশী বিলিরুবিন বের হয়। এ জন্য পায়খানা সব সময় হলুদ হয়। অন্যদিকে জন্ডিসের সাথে গরমের ভ্রান্ত ধারণা জুড়ে দেয়া হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে জন্ডিসের সাথে ঠান্ডা বা গরমের কোন সম্পর্ক নেই। জন্ডিস এমন একটি রোগ যা সম্পর্কে আমাদের দেশে অশিক্ষিত পুরুষ মহিলা থেকে শুরু করে শিক্ষিত ব্যক্তি পর্যন্তু অনেকে কোন কিছু না জেনেই এসব কুসংস্কারের বেড়াজালে আবর্তে বন্দি হয়। এ জন্যই এ রোগের চিকিৎসার শরুতেই রোগীর ভুল ধারণা, মারাত্মক ভীতি ইত্যাদি দূর করা অতীব প্রয়োজন। রোগীকে আশ^স্ত করতে হয়। চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী রোগীর সকল প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ও সন্তোষজনক জবাব দেয়া প্রয়োজন।
আধুনিক চিকিৎসা: রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলা হয়। রক্তের সেরাম বিলিরুবিন ১.৫ মি. গ্রা. এল. পর্যন্ত নামা এবং অন্যান্য উপসর্গ দূরীভূত হওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। রোগীকে স্বাভাবিক সব খাবার থেকে বলা হয়। অনেকেই মনে করেন তরকারীতে হলুদ মশলা দেয়া নিষেধ। কারণ রোগীর শরীর হলুদ এবং হলুদ খেলে জন্ডিস আরো বেড়ে যাবে। প্রকৃত অর্থে জন্ডিসের হলুদ এবং তরকারীর হলুদ এক নয়। অনেক হলুদ খেলেও কারো জন্ডিস হবে না। বরং জন্ডিসের রোগীদের খাবারে অরুচি থাকে। মসলা না দিলে যে বিস্বাদ খাবার তৈরি হয় তাতো সুস্থ রুচিওয়ালা মানুষই খেতে পারে না আর অসুস্থ রুচিহীন রোগী তা কেমন করে খাবেন? হেপাটাইটিসের রোগীকে তার পছন্দমত খাবার দেয়া প্রয়োজন। তা চর্বি হোক আর আমিষই হোক না কেন। খেতে না পারলে স্যালাইনের মাধ্যমে দিতে হবে। গ্লুকোজ, আখের রস, ফল, ডাবের পানি ইত্যাদি খাবারে ক্ষুধা নষ্ট করে বিধায় তা খেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। আর রাস্তার নোংরা আখের রসতো জন্ডিসের জীবাণু বহণ করা সম্ভাবনাই বেশী। বেশী প্রোটিন খেলে হেপাটাইটিস দ্রুত আরোগ্য হয়। হেপাটাইটিসে বেশীরভাগ রোগীই আরোগ্য লাভ করে। এ রোগের মৃত্যুর হার ০.৫% থেকে ৩%। আরোগ্য লাভের পর প্রতি মাসে চিকিৎসকের কাছে ১ বার ফলো আপ দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে। এটি বেশী জরুরী বি, ও, সি ভাইরাসের ক্ষেত্রে। হেপাটাইটিসে আতঙ্কিত হবার তেমন প্রয়োজন নেই। বরং আপনার মনে উদিত প্রশ্নটির উত্তর এখনি আপনার চিকিৎসকের কাছ থেকে জেনে নিন। আপনার রোগ সম্পর্কে খোলামেলা আলাপ করুন। এ বিষয়ে মূর্খ ব্যক্তির ভ্রান্ত পরামর্শ বর্জন করুন। আপনার ও আপনার পরিবারের করণীয় সম্পর্কে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
ডা: মো: শাহিনুল আলম