সাম্প্রতিক রোগ
প্রতিকার ও প্রতিরোধ
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত ভাইরাস জ্বর। এই জ্বরের প্রকোপ দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া-ভারত, বাংলাদেশ, দক্ষিন আমেরিকা ও আফ্রিকায় বেশি দেখা যায়। কয়েক বছর পর পর ব্যপক আকারে এই রোগ ফিরে আসে। আমজনতার অশিক্ষা, সাধারন স্বাস্থ্যজ্ঞানের অভাব, সমন্বিত পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থার অভাব, প্রাথমিক ও কমিউনিটি স্বাস্থ্য কাঠামোগত দুর্বলতা, দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এসব কারন প্রকট হওয়ার বাংলাদেশে ডেঙ্গু ইদানীং ব্যাপক স্বাস্থ্য সমস্যা ও আর্থ-সামাজিক দুরবস্থা সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ সাধারনত জুন থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যমত্ম পরিলক্ষিত হয়। প্রতি বছর এটা বিপজ্জনক আকারে হয় না, তাই দীর্ঘসময় এটা কোন আলোচনার সৃষ্টি করে না। যে বছর এই রোগে অধিকসংখ্যক মানুষ আক্রামত্ম হয় শুধু সে বছরই এটা হয়ে ওঠে প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, ব্যাপক মাশুল গণনার পরই মন আসে- A Stitch in time saves nine. ইতিহাস বলে, ১৭৭৯-১৭৮০ সালে প্রথম এশিয়ার ব্যাপকভাবে এ রোগের আবির্ভাব ঘটে, বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিসত্মান) প্রথম চিহ্নিত হয় ১৯৬০ সালেঅ দীর্ঘবিরতির পর বার বার ফিরে আসে এই রোগ, বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। একটি আরএনএ (RNA) প্রকৃতির ভাইরাস এই ডেঙ্গু জ্বরের কারণ। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রথম আবিষ্কার করেন ইউএস আর্মির চিকিৎসক ডা.অ্যালবার্ট স্যাবিন।এডিস ইজিপ্টি (Aedes Egypti) মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের দেহে প্রবেশ করে। পুরম্নষ মশা মানুষকে কামড়ায় না। কেবল স্ত্রী জাতীয় এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করে। এই মশা দৈর্ঘ্যে ৩-৪ মিলিমিটার, সাদা কালো রঙে মিশেল। পরিষ্কার স্থির পানি। যেমন- ফুলের টব, ফুলদানি, বালতিতে তিন-চার দিনের জমা পানি, পরিত্যক্ত টায়ারে জমা পানি, পরিত্যক্ত কোন পাত্রে জমানো পানি, ছাদ বা সানসেটে জমা পানি- এসব জায়গায় স্ত্রী জাতীয় মশা ডিম ছাড়ে। তবে প্রায় ১০ দিন পর পূর্ণাঙ্গ মশা আত্মপ্রকাশ করে। এই মশাটি সাধারনত রাতে কামড়ায় না, দিনের বেলায় মানুষকে কামড়ায়। একজন মানুষের দেহ থেকে স্ত্রী এডিস মশা ভাইরাস গ্রহণ করে নিজের লালাগ্রন্থিতে জমা রাখে, তারপর সুস্থ্য মানুষকে কামড়িয়ে এই ভাইরাস দান করে। কিন্তু মশা নিজে কখনোই এ ভাইরাস দ্বারা আক্রামত্ম হয় না। মশাটি সাধারনত ৬৫ দিন বাঁচে। একবার আক্রামত্ম মানুষকে কামড়ানোর ১৫ দিন পর থেকে আমৃত্যু এই মশা অন্য মানবদেহে ডেঙ্গু ভাইরাস বিতরণ করে।
ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ
সুস্থ দেহে ভাইরাস প্রবেশের পর ২-৭ দিন পর রোগর লক্ষন শুরম্ন হতে পারে। এ রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রামত্ম হয় শিশু ও প্রাপ্তবয়স্করা। প্রাথমিক অবস্থায় (Prodromal Phase) শরীর ম্যাজম্যাজ ভাব, মাথাব্যাথা পরিলক্ষিত হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগীদের কোনো লক্ষন দেখা যায় না।
যাদের রোগের লক্ষন দেখা দেয় তা সাধারণত নিমণরম্নপ হয়ে থাকে-
-
ক্লাসিক ডেঙ্গু জ্বর।
-
ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর বা ডেঙ্গু শক ডিন্ড্রোম।
এখানে ক্লাসিক ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে বিসত্মারিত জানার চেষ্টা করব।
লক্ষনগুলো কী হতে পারে
-
হটাৎ করে শরীরের তাপমাত্রা তীব্রভাবে বেড়ে যেতে পারে। এটা একনাগাড়ে ৫-৭ দিন থাকতে পারে অথবা ৩-৪ দিন পর তাপমাত্রা বাড়তে পারে, এভাবে মোট ৭-৮ দিন চলতে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞারে ভাষায় Biphasic ও Saddleback বলা হয়।
-
তীব্র মাথা ব্যাথা, চোখের পেছন দিকে ব্যাথা হতে পারে, যা চোখ নাড়ালে বেড়ে যেতে পারে, চোখ দিয়ে পানি পড়তে পারে, চোখ আলো সংবেদনশীল হতে পারে।
-
মেরম্নদন্ডে প্রচন্ড ব্যাথা হতে পারে, কোমরের দিকে, পায়ের জোড়াগুলোতে খুব ব্যাথা হতে পারে, এটাকে বলা হয় Break Bone Fever।
-
চামড়ায় ছোট ছোট লাল দাগ দেখা দিতে পারে, এই দাগ প্রথমে বুকে বা বাহুতে দেখা দেয়, তারপর তৃতীয়-পঞ্চম দিনে পেটে দেখা দিতে পারে, লক্ষণীয় এই লাল দাগ হাতের তালবিা পায়ের তালুতে কখোনই দেখা যাবে না।
-
ক্ষুদা মন্দা ভাব, বমি বমি ভাব থাকতে পারে।
-
কারো কারো ক্ষেত্রে লসিকাগ্রন্থি ফুলে যেতে পারে।
-
অল্প রক্ত ক্ষরণ হতে পারে কিছু ক্ষেত্রে- যেমন দাঁতের মাড়ি থেকে, নাক দিয়ে সামান্য রক্তক্ষরণ , বমির সাথে কিছুটা রক্ত আসতে পারে, মুথগহবরে তালুতে (Soft Palate) রক্ত জমাট বেধেঁ ছোট ছোট বিন্দুর মতো দেখা দিতে পারে।
-
জ্বর ছেড়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর্যমত্ম দুর্বল ভাব, অস্বসিত্ম অনুভব, সব কিছুতে অনীহহা থাকতে পারে।
এখানে লক্ষণীয় যে, ক্ল্যাসিক ডেঙ্গু জ্বরে কখনোই কাশি থাকতে পারে না।
এই রোগ নির্ণয়ের জন্য কিছু পরীক্ষা করা যেতে পারে, যেমন-
-
রক্তের শ্বেতকণিকা, অনুচক্রিকার পরিমাণ পরীক্ষা করে স্বাভাবিকের চেয়ে কম পাওয়া যেতে পারে।
-
টিস্যু কালচার করে ডেঙ্গু ভাইরাস প্রথকীকরণ করা যেতে পারে।
-
Immunoglobulin এ antibody চার গুন পর্যমত্ম বেড়ে যেতে পারে।
ক্ল্যাসিক ডেঙ্গু জ্বরের নিদিষ্ট কোন চিকিৎসা নেই। প্রচন্ড গা-মাথা ব্যাথা, জ্বরের জন্য শুধু প্যারাসিটামল সেবন করা যেতে পারে। কোনভাবেই অ্যাসপিরিন বা অন্যান্য ব্যাথা নাশক ওষুধ সেবন করা যাবে না। কারন এসব ওষুধ ডেঙ্গু রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারন হতে পারে। প্রচুর পরিমান পানীয় পান করতে হবে। যোকোন সমস্যায় চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে। যদি রক্ত ক্ষরণ প্রচুর পরিমানে হয় বা রোগের লক্ষন তীব্র আকারে দেখা দেয় বা রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক মনে হয়, তাহলে অবশ্যই রোগীকে যথাসম্ভব দ্রম্নত হাসপাতালে স্থানামত্মর করতে হবে। ডেঙ্গ হেমোরোজিক জ্বরে সাধারণত শিশুরা বেশি আক্রামত্ম হয়, তাই শিশুদের ব্যাপারে বিশেষভাবে সাবধান থাকতে হবে। ডেঙ্গু একটি নিয়ন্ত্রনযোগ্য রোগ। আমাদের সবার সচেতনতায় এই রোগ নির্মূল করা সম্ভব। রোগটি যথাযথ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রনে আমাদের করণীয়:
-
পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন পরিবেশ নিশ্চিত করা।
-
ডেঙ্গুবিরোধী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
-
প্রতিটি বাড়ি ও স্থাপনার আশেপাশের জায়গা-জমি পরিস্কার রাখা।
-
সব ড্রেন, খাল-নদীনালার প্রবাহ চলমান রাখা।
-
পুকুর, ডোবা আবর্জনামুক্ত রেখে মাছ চাষের ব্যবস্থা করা।
-
বড়ির ভেতরের পানির ট্যাঙ্ক, মসেপটিক ট্রাঙ্ক নিয়মিত পরিস্কার ও মশার বিচরণমুক্ত রাখা।
-
ফুলের টর, অব্যাহৃত টায়ার, পানির পাত্র ইত্যাদিতে পানি জমতে না দেয়া।
-
পরিবেশবান্ধব ইনসেক্টিসাইড স্প্রে ব্যবহার করে মশা নিধন করা।
-
দিনের বেলায় ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা। এ ব্যাপারে শিশুদের প্রতি বিশেষভাবে যত্নশীল হতে হবে।
-
নিজ নিজ এলাকার ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ দেখা দিলে ভীত না হয়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা।
কারোর একবার ডেঙ্গু নির্ণীত হলে সাধারণত আর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রামত্ম হওয়ার আশঙ্কা থাকে না, যদি ভবিষ্যতে আক্রামত্ম হয় তাহলে তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মারাত্মক হতে পারে। এই রোগে মৃত্যু হার শতকরা ১০ ভাগ। সুতরাং ডেঙ্গকে ভয় না পেয়ে আসুন আমরা সবাই ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন ও সচেষ্ট হই।